লেখনী চর্চা, জীবন ও সাহিত্য ভাবনায়
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
-সুনির্মল বসু
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন তাঁর রচিত সাহিত্যে সামাজিক নিয়মকানুনকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের রচিত সাহিত্যে ভাবালুতা প্রাধান্য পাচ্ছিল, তখন শরৎচন্দ্র মাটির কাছাকাছি মানুষের ছবি সাহিত্যে তুলে ধরেছিলেন।
তিনি বলতেন- এই দেশে, এই সমাজে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, তাই এই সমাজকে আমি মানি। কিন্তু তাই বলে দেবতা বলে নয়।
শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং জননীর নাম ভুবন মোহিনী দেবী।
লেখকের শৈশব কেটেছে কিছুদিন ভাগলপুরে। ছোটবেলায় পড়াশোনা করেছেন, প্যারী পন্ডিতের পাঠশালায়। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন, দুর্গাচরণ বিদ্যাপীঠ এবং দেব নারায়ন জুবিলী হাই স্কুলে।
দারিদ্র্যের কারণে উচ্চশিক্ষায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। জীবনের পাঠশালায় তাঁর যথার্থ শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছিল।
নিজেই বলেছেন, “মাত্র ষোলোটা টাকার অভাবে এফ.এ. পরীক্ষাটা দিতে পারিনি, তখন বামুন কায়েতদের বাড়ি গিয়েছি, তাঁরা সব দূর দূর করে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, তখন কাহার, বাগদি, দুলে, এদের কাছে গিয়েছি। এরা আমাকে পরম আদরে কাছে টেনে নিয়েছে, এদের কাছেও আমার ঋণ কি কম?”
বেনামে মামা সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে “মন্দির” গল্প লিখে, তিনি কুন্তলীন পুরস্কার পান। এরপর একে একে লেখেন, বড়দিদি, মেজদিদি, বিপ্রদাস, দেবদাস, দত্তা, গৃহদাহ, বিরাজ বৌ, চন্দ্রনাথ, পরিণীতা, পল্লীসমাজ, বামুনের মেয়ে, প্রভৃতি উপন্যাস। একমাত্র রাজনৈতিক উপন্যাস লেখেন, পথের দাবী। ইংরেজ পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগারড বইটি বাজেয়াপ্ত করেন এবং শরৎচন্দ্রের রিভলবার সীজ করেন।
এইসময় শরৎচন্দ্র উত্তর হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নিকট সম্পর্কে এসেছিলেন।
নিজের লেখা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা উৎপীড়িত, নিপীড়িত মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কোনো হিসাব নিলে না, এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই আমাকে পাঠালে, মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।
অসহায় মানুষের প্রতি নিবিড় সহানুভূতি বোধ, প্রবল পর্যবেক্ষণশক্তি এবং গভীর জীবনবোধ তাঁকে জনগণমন-অধিনায়ক লেখকে পরিণত করেছিল।
তিনি সাহিত্যে দেখাতে চেয়েছিলেন, পাঁকের মধ্যেও পদ্ম জন্মায়। প্রশ্ন তুলেছিলেন, সতীত্ব কোথায় থাকে, দেহে না মনে। তাঁর জবাব ছিল, সতীত্ব মনে থাকে, শরীরে নয়। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, সতীত্ব বড়, না নারীত্ব বড়। নিজেই সারাজীবন নিজের লেখায় উত্তর দিয়েছেন, সতীত্বের চেয়ে নারীত্ব অনেক বড়।
রবীন্দ্রনাথ একটা কবিতায় লিখেছিলেন, “জীবনে জীবন যোগ করা, না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।” শরৎচন্দ্র সাধারন মানুষের সঙ্গে জীবন যোগ করতে পেরেছিলেন।
চারটি পর্বে দীর্ঘ আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখেছিলেন, শ্রীকান্ত। পঞ্চম পর্ব লিখে যেতে পারেননি। সেটি লিখেছিলেন, লেখক প্রমথনাথ বিশী।
গৃহদাহ উপন্যাসে ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন। পল্লীসমাজ উপন্যাসে গ্রামীন রাজনীতি ও মানুষের স্বার্থপরতার পাশাপাশি, গঠনশীল জীবনযাত্রা বর্ণনা রয়েছে।
ডাক্তার অমর চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা পার্বতীকে তিনি ভালোবেসে ছিলেন। সেই সূত্রে লেখেন, দেবদাস, উপন্যাসটি। লেখক হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর এই ব্যক্তিগত উপন্যাসটি যেন ছাপা না হয়। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি ছাপা হয়েছিল। অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারণে এটি বারবার চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে।
রেঙ্গুনে একাউন্ট অফিসে চাকরি করবার সময় তিনি সেখানকার বেঙ্গলি ক্লাবে গান গাইতেন। শরৎচন্দ্র গায়ক হতে গিয়ে, লেখক হয়েছিলেন।
সাহিত্যচর্চার প্রথমদিকে তাঁর সঙ্গে একইসঙ্গে লিখতেন লেখিকা অনুরূপা দেবী।
একটি বৃষ্টির দিনে কবি নরেন্দ্র দেব পত্নী রাধারানী দেবী শরৎচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, শরৎদা আপনি হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে রেঙ্গুনে চলে গেলেন কেন? উত্তরে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, সে যে বললো, আপনি এই শহরে থাকলে, আমার অশান্তি, আমি চাই না, আপনি এই শহরে থাকুন। তারপরে, এক লাফে একেবারে পগারপার।
শরৎচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন, প্রথমে শান্তি দেবীকে, পরে হিরণ্ময়ী দেবীকে।
তাঁর লেখা বিখ্যাত ছোট গল্পগুলি হল, হরিলক্ষ্মী, দেওঘরের স্মৃতি, অভাগীর স্বর্গ ও মহেশ।
মহেশ, তাঁর লেখা পৃথিবী কাঁপানো গল্পের একটি। গল্পের শুরুতে তিনি লিখেছিলেন, “গ্রামের নাম কাশিপুর। গ্রাম ছোট, জমিদার আরো ছোট। কিন্তু দাপটে তাহার গ্রামের লোকেরা টু শব্দটি পর্যন্ত করিতে পারেনা, এমনই প্রতাপ।
এই গ্রামে পথের পাশে পিটুলি গাছের ছায়ায় গফুর জোলার বাড়ি। মা মরা মেয়ে আমিনা এবং অবলা জীব মহেশকে নিয়ে তাঁর ঘর গৃহস্থালী। সে তাঁকে পেটপুরে খেতে দিতে পারে না। তাই কন্যা আমিনার সঙ্গে তাঁকে মিথ্যে অভিনয় করতে হয়।
গল্পের পরিসমাপ্তিতে গফুর মহেশকে খুন করেছে।
নক্ষত্রখচিত রাতে বাবলা গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে গফুর। কন্যা আমিনার হাত ধরে পথে নেমে, শূন্যে দু হাত তুলে প্রচলিত বিশ্ব বিধানের উদ্দেশ্যে হাহাকার করে বলে উঠেছে,
আল্লাহ, আমায় যত খুশি সাজা দিও, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে, তার চরে বেড়াবার মত এতোটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া পুকুরের জল আমার মহেশকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি কখনো মাফ করো না।”
চরিত্রহীন উপন্যাস লিখে, শরৎচন্দ্র খুব টেনশনে ছিলেন। কাজের লোকের সঙ্গে প্রেম, মানুষ কিভাবে গ্রহণ করবে। বাজে শিবপুরের বাড়িতে এক দুপুর বেলায় তিনি যখন শরৎচন্দ্র শেঠের দোকানে বসে আছেন, তখন কলকাতা থেকে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা তাঁর খোঁজ করলেন। শরৎচন্দ্র বুঝলেন, যা আশঙ্কা করেছিলেন, সেই বিপদ সামনে এসে গেছে। তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন, বললেন, আমিই শরৎচন্দ্র।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমি আপনাকে প্রণাম করতে এসেছি। আমি আপনার চরিত্রহীন উপন্যাস পড়েছি। আপনার চরিত্রহীন উপন্যাস আমার চরিত্র রক্ষা করেছে।
এই কথায় সেদিন অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে খুব স্নেহ করতেন। শরৎচন্দ্র কবিকে অশেষ শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে মন কষাকষি করে বাড়ি ফিরে, আবার তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে যেতেন।
একদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে জুতো খুঁজে পাননি বলে, পরদিন জুতো পেপারে মুড়ে বগলে করে এলেন। রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করে বললেন, কি হে শরৎচন্দ্র, আজ কি উপন্যাস পড়বে, পাদুকা পুরান নাকি।
মানুষ থাকে না। আদর্শ থেকে যায়। শরৎচন্দ্র নেই, শরৎ সাহিত্য রয়েছে।
কে বড় লেখক, রবীন্দ্রনাথ, না শরৎচন্দ্র।
রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, আমি তো কবি।
অর্থাৎ লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্রকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
যে মেয়েকে পাত্রপক্ষের কাছে বিবাহের আগে বারবার হেনস্থা হতে হয়, তাঁকে জীবনে নয়, সাহিত্যে জেতাতে পারতেন একজনই। তিনি শরৎচন্দ্র।
তাঁর প্রথম আবির্ভাবের দিনে রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎবাণী ছিল, বাংলা সাহিত্যে শরতের চাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে, ও বিশাল ক্ষমতা নিয়ে এসেছে, ওকে দেখো।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র অকাল মৃত্যুর খবর এলে, অতিশয় বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“যাহার অমর স্থান প্রেমের বাঁধনে,
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।”